Print

মন্দির নির্মাণ

পুরীর বর্তমান জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ চোড়গঙ্গদেবই যে প্রথম শুরু করেন সেকথা তাঁর প্রপৌত্র রাজরাজাদেব দ্বিতীয়র (১১৭০-১১৯০ খিষ্টাব্দ) তাম্রশাসনেই উল্লিখিত আছে। গঙ্গরাজবংশের প্রশস্তি লেখকরা লিখছেনঃ

‘পাদৌ যশ্য ধরন্তরীক্ষমাখিলম।

নাভিস্তু সর্বাধীশঃ ॥

শ্রোত্রি নেত্রযুগম রবিন্দুযুগলম।

মূর্ধপিকা দায়ুরাসৌ ॥

প্রসাদম পুরুষোত্তমাস্য নৃপাতে কো নামা।

কার্তুম স্কামা ॥

তস্যেৎআদ্যানর পৈরুপেকসিতো মায়ম কাকরেথা।

গঙ্গেশম্ভার ॥

অর্থাৎ সেই রাজাকে কী নামে ডাকা যায় যিনি ভগবান পুরুষোত্তমের এতবড় একটি মন্দির নির্মাণ করতে পারেন। যাঁর পদযুগলের নিচে তিন পৃথিবী, যাঁর নাভিদেশ সমস্ত আকাশ, যাঁর কর্ণদুটি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব ও পশ্চিম এই চার কোণের সঙ্গে যুক্ত, যাঁর চোখদুটি চন্দ্র ও সূর্য এবং যাঁর মস্তক স্বর্গ। এরকমই একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মান্দর নির্মাণের কাজ পূর্ববর্তী রাজারা অবহেলা করেছেন, যা একমাত্র গঙ্গেশ্বরই শুরু করতে পেরেছেন।

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। শ্রীপুরুষোত্তমের বর্ণনা প্রসঙ্গে তিন লোক অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের অধীশ্বররূপে তাঁকে দেখানো হয়েছে। ভগবদ্ গীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দর্শনের ক্ষেত্রেও এই একইভাবে শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের অধীশ্বর। যা কিছু চেতন-অচেতন সব তিনিই।

ভারতবর্ষের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরুদেব পুরীতে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা ছিল চোড়গঙ্গদেবের। তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল দক্ষিণের চোল ও চালুক্য রাজবংশের সঙ্গে। সেই সময় বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের গূঢ়তত্ত্ব সারা ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে প্রচার করছিলেন শ্রী-বৈষ্ণব শিক্ষকদের অন্যতম আচার্য রামানুজ। দক্ষিণ ভারতের শ্রী বৈষ্ণব ধর্ম নিজের রাজ্যে প্রচারের ব্যাপারে আগ্রহবোধ করেন চোড়গঙ্গদেব। রামানুজ ও তাঁরই মতো ধর্মীয় গুরু এবং দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে উড়িষ্যায় জনপ্রিয় করে তুলতে চোড়গঙ্গদেব তাঁর সম্পদ ও সময় ব্যয় করেন। রামানুজের শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন তিনি।

রামানুজ কিছুদিন পুরীতে ছিলেন। ততদিন জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মন্দিরের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে রামানুজের প্রভাব এতটাই ছিল যে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী শ্রীজগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। পুরীর মন্দিরের পূর্ব দিক থেকে মন্দিরের শিখরদেশ লক্ষ করলে তিলক আকৃতির একটি চওড়া চিহ্ন চোখে পড়ে। একে ‘রামানুজ-তিলকবলে। রামানুজ সম্প্রদায়ের লোকজন কপালে এরকমই তিলক পরেন। এই রামানুজ-তিলক মন্দিরের শিখরদেশে ‘অমালকাশিলায় স্থান পেয়েছে। এই অংশের গঠন অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো। এবং তা আমলকী ফলের মতো মসৃণ। তাই একে আমলকা শিলা বলে। ওড়িয়াতে মন্দিরের শিখরদেশে এই অংশটিকে বলে ‘অংলা-বেড়া। আমলকীরই অপভ্রংশ।

উত্তর-পূর্ব ভারতে মূলমান আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে বাহ্মণ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রাজানুকুল্যের কারণে পুরীতে আসা নিরাপদ বলে মনে করতেন। আর তাঁরা দলে দলে আসতেও লাগলেন এখানে। পুরীর শ্রীপুরুষোত্তমের মাহাত্ম্য, এখানে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি মন্দির ও মঠ আর উত্তাল সমুদ্রের হাতছানি সেই কবে থেকে মানুষের আকর্ষণের কারণ। যা আজও অম্লান।

হিন্দু পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রে ভারতবর্ষের চারটি প্রসিদ্ধ ধামের বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে পুরী অন্যতম। পুরীর নাথ মানে জগন্নাথ ( পূর্বভারত ), দক্ষিণভারতে রামনাথ, পশ্চিমভারতের গুজরাতে দ্বারকানাথ এবং উত্তর ভারতে বদ্রীনাথ। রামনাথ রামেশ্বর ধামের প্রধান দেবতা। তীর্থযাত্রীরা প্রত্যেকটি ধামেই পুণ্যার্জনের জন্য দলে দলে আসেন। কিংবদন্তি এরকম, প্রভু জগন্নাথ বদ্রীনাথে স্নান করেন, দ্বারকায় বেশভূষা পরিধান করেন, পুরীতে অন্ন ভোজন করেন, এবং রামেশ্বর ধামে শয়ন করেন। সেই কারণে পুরী ধাম জগন্নাথদেবের ভোজন ধাম রূপেও প্রসিদ্ধ। কথায় আছে-‘জগন্নাথকা ভাত, জগৎ পসারে হাত।জগন্নাথদেবের অন্নলাভের আশায় সারা বিশ্বের মানুষ হাত বাড়িয়ে রয়েছেন।

গঙ্গবংশের দ্বিতীয় রাজা কামর্নাভদেবের ঈশ্বরভক্তি ছিল অতুলনীয়। যুবরাজ হিসেবে তাঁর অভিষেক সর্বলোকৈকানাথ মন্দিরে হয়। সর্বলোকৈকানাথ হলেন শ্রীপুরুষোত্তম। এ থেকেই বোঝা যায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ অনেক আগেই পুরীর শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এবং তাঁরা পূজিত হচ্ছিলেন। অনন্তবমৃন চোড়গঙ্গদেব এই গর্ভগৃহের অনেকটাই নির্মাণ করেন। তবে তাঁর সপ্তম পুরুষ রাজা অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়র (১২১১-১২৪২ খ্রিস্টাব্দ ) সময়েই এই মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় বলে জানা যাচ্ছে। অনঙ্গভীমদেবের তৃতীয়র তাম্রলিপিতেই একথারয়েছে। তিনি অনিয়ঙ্কভীম তৃতীয় নামেও পরিচিত ছিলেন। অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়র তাম্রলিপিতেই জানা যায় ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দের পয়লা মার্চ, বৃহস্পতিবার দুপুরে একাদশী শুরুর মুহূর্তেই ( সকাল ১১-৩০ মিনিটের পর ) নতুন মন্দিরে শ্রীপুরুষোত্তম, বলভদ্র ও সুভদ্রার নতুন বিগ্রহ যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদলাপাঁজিতেও অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়কেই পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ শেষ করার কৃতিত্ব ওদওয়া হয়েছে। এই মাদলাপাঁজি অনুযায়ী গর্ভগৃহের লাগোয়া জগমোহনের উন্নতিসাধন তিনিই করেন।

আবার কটক-রাজা বংশাবলী থেকে জানা যায়-

‘শাকাব্দে রন্ধ্র-শুভ্রাংশু-রূপ-নক্ষত্রনায়কে।

প্রাসাদং কারিতো রাজা অনঙ্গভীমেন ধীমতা ॥’

অর্থাৎ শক বৎসর ১১১৯(১১৯৭ খিস্টাব্দ)-এ রাজা অনঙ্গভীমদেব পুরীর শ্রীপুরুষোত্তমের প্রাসাদ নির্মাণ শেষ হয়েছে সেই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। এবং এই উত্তরও পাওযা যায় সহজে। ১১৯০ থেকে ১১৯৮ খিস্টাব্দ পর্যন্ত গঙ্গবংশের অনঙ্গভীমদেব দ্বিতীয় কলিঙ্গের রাজা ছিলেন। কটক-রাজ-বংশাবলীর তথ্যকে যদি সঠিক বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে তাঁর সময়েই এই মন্দির নির্মাণ শেষ হয়। গঙ্গবংশের এই পঞ্চম রাজা নির্মিত মন্দিরটির নাম ছিল ‘শ্রীবৎস খন্ডশাল।এর গর্ভগৃহের উচ্চতা প্রায় ১৩৫ ফুট। অনঙ্গভীমদেব দ্বিতীয়র ইচ্ছা ছিল গর্ভগৃহের উচ্চতা কম করেও ১৬৫ ফুট হোক। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীরা অযথা সময় নষ্ট হবে ভেবে গর্ভগৃহের উচ্চতা ১৩৫ ফুট রাখার জন্যই রাজাকে পরমর্শ দেন।

অথচ অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়র তাম্রলিপিতে পাই তিনিই পুরীর মন্দিরের নির্মাণ শেষ করেন। ঐতিহাসিক রাজেন্দ্রলাল মিত্র মন্দির নির্মাণের পুরো কৃতিত্ব তাঁকেই দিয়েছেন। মাদলাপাঁজিতে এ কখাও রয়েছে শ্রীপুরুষোত্তম মন্দিরের ভেতরে একটা গভীর কুয়ো ছিল। এটি অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়ই খনন করেন। যুদ্ধে জয়লাভের পর হাতির পিঠে বহু ধন রত্ন চাপিয়ে সেই কুয়োতে এনে ফেলা হত। এই কুয়োকে ‘সুনা কুয়াবলে। কুয়োটি সোনা-দানায় পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরই তিনি মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করার দিকে নজর দেন। তাহলে কোনটা সত্যি ? অনঙ্গভীমদেব দ্বিতীয় নাকি তাঁর নাতি অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়ই পুরীর মন্দিরের নির্মাণ শেষ করেন ?

সন্দেহ নেই অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেবের পর একশো বছরের মধ্যেই এই মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। এবং অনঙ্গভীমদেব দ্বিতীয় ও তৃতীয় দুই রাজার রাজত্বকালেই শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ব্যাপক নির্মাণ কাজে পর্যায়ক্রমে হাত দেওয়া হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহ যা ‘বিমাননামে পরিচিত সেটি চোড়গঙ্গদেবই অনেকটা তৈরি করে যান। বিমানের বাকি অংশ, জগমোহন, নাটমন্দির ইত্যাদি যথাক্রমে অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়র ঐকান্তিক আগ্রহেই গড়ে ওঠে। তবে পাঠকদের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতেও পারে। বর্তমান শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের উচ্চতা মটিথেকে ২১৪ ফুট ৮ ইঞ্চি। অথচ ‘শ্রীবৎস খন্ডশালনামক মন্দিরটির মোট উচ্চতা ১৩৫ ফুটের বেশি নয়। উচ্চতার ক্ষেত্রে এই আশি ফুটের ব্যবধান কীভাবে ঘটল ? তাহলে কি পরবর্তীকালে উড়িষ্যার আর কোনও রাজা বিমানের উচ্চতা বাড়ানোর কাজে উদ্যোগী হন ? এর যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর উড়িষ্যার কোনও ােজার তাম্রপত্র বা মাদলাপাঁজিতে পাওয়া যায় না।