জগন্নাথদেবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাজা মান সিংহের ভূমিকা
জগন্নাথদেবের অন্নভোগ নতুন করে শুরু করার ব্যাপারে রামচন্দ্রদেব উড়িষ্যা ও উড়িষ্যার বাইরে বিভিন্ন জায়গার ব্রাহ্মণ ও পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। রাজার প্রস্তাপ প্রত্যেকেই সমর্থন করেন। যেদিন মন্দিরের গর্ভগৃহে তিন বিগ্রহের সামনে অন্নভোগ নিবেদন করা হল সেদিন রামচন্দ্রদেব স্বয়ং একটি বড় পাত্রে অন্নরূপী এই মহাপ্রসাদ জগমোহনের জয়-বিজয় দ্বারের সিঁড়িতে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে এই মহাপ্রসাদ প্রথম গ্রহণ করেন তিন ব্রহ্মণপণ্ডিত যথাক্রমে রামচন্দ্র ভট্ট, গোবর্ধন প্রহরাজ ও মিশ্র গোঁসাই। মহাপ্রসাদ গ্রহণ করার নিয়ম আছে। মাটিতে বসে অত্যন্ত শুদ্ধ মনে ভক্তিভরে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতে হয়।
মহাপ্রসাদ গ্রহণ করার পর ওই তিন ব্রহ্মণপণ্ডিত হাত-মুখ ধোননি। যেহেতু জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ সব থেকে পবিত্র ভোগ তাই এটি মুখে দেওয়ার পর ওই তিনজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রদ্ধা সহকারে তাঁদের ডান হাত মাথায় মুছে নেন। তাঁদের দেখাদেখি সেদিন মন্দিরে উপস্থিত অন্য জগন্নাথ-ভক্তরাও এভাবেই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন। সেদিনই মন্দিরে সকলের সামনে রাজা রামচন্দ্রদেবকে ‘দ্বিতীয় ইন্দ্রদ্যুম্ন’ বা ‘অভিনব ইন্দ্রদ্যুম্ন’ নামে ভূষিত করা হয়। কারণ, জগন্নাথদেবকে তিনিই নতুন করে পুরীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। স্কন্দপুরাণের বর্ণনা অনুসারে অবশ্য সত্যযুগে মালবদেশের সার্বভৌম রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নই পুরীতে একটি মন্দির নির্মাণ করে তাতে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন।
জগন্নাথদেবের দারুমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর উড়িষ্যার রাজা রামচন্দ্রদেবের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে তাঁকে ‘ঠাকুররাজা’ বলা হত। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবক তিনিই। পুরীর জগন্নাথ দর্শনে দূরদেশ থেকে যাঁরা আসতেন শ্রীমন্দিরে প্রবেশের আগে তাঁরা রাজদর্শন করতেন। এটাই ছিল তখনকার রীতি।
রাজা রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যই জগন্নাথদেবের চন্দনযাত্রার সময় পুরীতে এসেছিলেন মানসিংহ। পুরী আসার পথে পিপলিতে তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে রেখে আসেন মোঘল সেনাপতি। কারণ, তিনি রাজার সঙ্গে একা দেখা করতে চেয়েছিলেন। সম্রাট আকবরের মানসিংহের উপর সেরকমই নির্দেশ ছিল। তাঁর প্রধান সেনাপতি খুরদা ও পুরী জয় করার পরিকল্পনা করেছেন জানতে পেরে সম্রাটও খুশি ছিলেন না।
এরকমই সময়ে প্রয়াত বিখ্যাত রাজা মুকুন্দদেবের ছেলে আকবরের কাছে আর্জি জানালেন তাঁর পিতৃরাজ্য তাঁর হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হোক। রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে মুকুন্দদেবের ছেলের বিরোধ উত্তরোত্তর বেড়েই চলে। এই বিরোধে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরও অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে পড়ে। কীভাবে বলি।
মন্দিরের প্রধান সেবক হওয়ার অধিকার রামচন্দ্রদেবের নেই এই অভিযোগ করলেন মুকুন্দদেবের ছেলে। এবং সাধারণ মানুষকে তিনি খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। গোটা ব্যাপারটা নিয়ে মন্দিরের অন্য সেবকরা বেশ বিভ্রান্তির মধ্যেই পড়ে গেলেন। সেবকরা তখন মানসিংহকেই উড়িষ্যার সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার কে তা ঠিক করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মোঘল সম্রাট ও বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মানসিংহকে আদেশ করেন। পুরীর জগন্নাথদেবের বিভিন্ন বার্ষিক উৎসবের মধ্যে ‘চন্দন যাত্রা’ অন্যতম। এদিন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ঐতিহ্য হল মন্দিরের পূজারিদের দেওয়া ‘খাড়ি-প্রসাদ’ রাজাকেই প্রথম মাথায় ছুঁইয়ে গ্রহণ করতে হয়। চন্দন যাত্রা উৎসব শুরু হয় বৈশাখ মাসের শুক্ল তৃতীয়া অর্থাৎ অক্ষয় তৃতীয়ায়। এই উৎসব চলে ২১ দিন ধরে। চন্দন যাত্রা শুরু হওয়ার দিন মানসিংহ মুকুন্দদেবের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পুরীর মন্দিরে এলেন। রামচন্দ্রদেবও এসে পড়েছেন দুজনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন মানসিংহের পিছনে। সেবকরা যখন তাঁর কাছে জানতে চাইলেন এই প্রসাদ কে গ্রহণ করবেন তখন মানসিংহ রামচন্দ্রদেব ও মুকুন্দদেবের ছেলে দুজনের দিকেই একবার আড়চোখে তাকালেন। দুজনের হৃৎপিন্ডই তখন উত্তেজনায় ধকধক করছে। মানসিংহ কিন্তু রামচন্দ্রদেবকেই খাড়ি-প্রসাদ গ্রহণের অনুমতি দিলেন। এবং তাঁকে উড়িষ্যার রাজা ঘোষণা করলেন। এবং সেদিন থেকেই জগন্নাথদেবের সেবক হিসেবে রাজা রামচন্দ্রদেব পাকাপাকিভাবে ভারত-সম্রাট আকবরের অনুমতিলাভ করেন।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পরিচালন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা নেন মানসিংহ। সেই সময় মন্দিরের দৈনন্দিন সেবা পুজোর ব্যাপারে কয়েকজন ক্ষমতাশালী পাণ্ডা রাজা রামচন্দ্রদেবকে সাহায্য করতেন। এঁদের মধ্যে পরিছা বড় জেনা মহাপাত্র এবং মুকুন্দ পট্টনায়ক অন্যতম। পরিছা মানে রাজগুরু। জেনা মহাপাত্র ছিলেন বড় রাজগুরু। তিনি এবং মুকুন্দ পট্টনায়ক মূলত এই দুজন পান্ডাই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার প্রতিদিন বিভিন্ন বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা করতেন। জগন্নাথদেবের এই বিশেষ ভোগকে ‘কোঠভোগ’ বলে। এই ভোগ শুধু গর্ভগৃহেই তিন বিগ্রহের সামনে নিবেদন করা হয়। জগন্নাথদেবের অন্য প্রকার ভোগ যা গর্ভগৃহে নিবেদন না করে শুধু ভোগমন্ডপেই থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়, তার নাম ‘ছত্রভোগ’। এবং তিন বিগ্রহকে নিবেদনের পর মহাপ্রসাদরূপী এই ছত্রভোগ প্রতিদিন অসংখ্য তীর্থযাত্রী গ্রহণ করেন। ছত্রভোগ পয়সা দিয়েই কিনতে হয়। বিশেষ উৎসব ছাড়া এমনি সাধারণ দিনেই শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ছত্রভোগ ৫০ কুইন্টালের কাছাকাছি পৌঁছয় যা কমপক্ষে ২০ হাজার তীর্থযাত্রী গ্রহণ করতে পারেন। তবে প্রতিদিন কোঠভোগের মিলিত পরিমাণ কিন্তু এক দেড় কুইন্টালের বেশি নয়। এবং এই ভোগ বিক্রি করাও নিষিদ্ধ। এসব নিয়ে পরে আরও বিছু তথ্য জানতে পারব। রামচন্দ্রদেবকে সর্বসমক্ষে উড়িষ্যার রাজা হিসেবে ঘোষণা করার দু’বছর পর আবার জগন্নাথদেবের টানে পুরীতে আসেন রাজা মানসিংহ। এবার সস্ত্রীক।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের প্রচীন মুক্তিমণ্ডপের দূরবস্থা দেখে বর্তমান মুক্তিমণ্ডপটি মানসিংহ-পতœী গৌররানিই নতুন করে নির্মাণ করিয়ে দেন। ষোলোটি স্তম্ভের উপর এই মুক্তিমণ্ডপ। কিংবদন্তি এই যে, শ্রীজগন্নাথ মন্দির নির্মাণের সময় স্বয়ং ব্রহ্মা এখানে বসে শিল্পীদের নির্দেশ দিয়ে ওই নির্মাণকার্য করিয়েছিলেন। সেজন্য এটিকে ব্রহ্মাসন, যজ্ঞবেদি বা কল্যাণমণ্ডপও বলা হয়। বিভিন্ন ‘শাসন’-এর ষোলোজন ব্রাহ্মণ মুক্তিমণ্ডপে বসে শাস্ত্র আলোচনা করেন ও হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তীর্থযাত্রীদের আলোকিত করেন।
মুক্তিমণ্ডপের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের উপর আরও একটি কাজের দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরাই ওড়িয়া-পঞ্জিকা তৈরি করেন। এই পঞ্জিকা অনুযায়ীই রথযাত্রাসহ জগন্নাথদেবের বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। বিয়ে, মুখেভাত, পৈতে, ওড়িয়াদের নানা শুভ অনুষ্ঠান এই পঞ্জিকা অনুসারেই হয়। উড়িষ্যাবাসী বিশ্বাস করেন কেউ পাপকাজ করলে তার প্রায়শ্চিত্ত একমাত্র শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের মুক্তিমণ্ডপেই সম্ভব। রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের সময়ে মুক্তিমণ্ডপের কয়েকজন প্রবীণ পন্ডিতের নাম রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এঁরা হলেন বলভদ্র রাজগুরু, পুরন্দর পুরোহিত প্রমুখ। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের প্রশাসনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে মুক্তিমণ্ডপের গুরুত্ব আজও সীমাহীন। পুরীর মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বেরলে দক্ষিণে মুক্তিমণ্ডপ তীর্থযাত্রীদের চোখে পড়বেই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও আজও বসে রয়েছেন সেখানে।
‘শাসন’ কাকে বলে তা নিয়ে পাঠকদের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। রাজা, রানি বা মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত পুরীর আশপাশে কয়েকটি বিশেষ গ্রাম ‘শাসন’ নামে পরিচিত। মুক্তিমণ্ডপের ষোলোটি স্তম্ভ যেন এই ষোলোটি শাসন-পণ্ডিতেরই প্রতিনিধিস্বরূপ। অবশ্য এখন চব্বিশটি শাসনের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা মুক্তিমণ্ডপে বসার অধিকারী।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরসহ উড়িষ্যার বিভিন্ন মন্দিরের পুজো-অর্চনা নিয়ে কখনও কোনও মতান্তরের সৃষ্টি হলে কোনটা ঠিক তা নির্ণয় করার জন্য মুক্তিমণ্ডপের পণ্ডিত-পরিষদের দ্বারস্থ হতেন যুযুধান দুই পক্ষ। এবং এক্ষেত্রে পণ্ডিত-পরিষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হত সকলকে। আজও এই ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। তবে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার পুজো-অর্চনার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে মন্দিরের পান্ডাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন মুক্তিমণ্ডপের পণ্ডিতরা। এঁদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার পুজো যাঁরা করবেন তাঁদের আরও উপযুক্ত করে তোলা। একসময় পুরীতে আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত গোবর্ধন মঠ পুরীর মন্দিরের পূজারিদের পুজো-অর্চনার ব্যাপারে পথনির্দেশ করত। পুরীর মন্দিরে ভোগ নিবেদনের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন শঙ্করাচার্য। কয়েকটি নতুন পদ জগন্নাথদেবের ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই সময় একে ভোগবর্ধন মঠ বলা হত। পরে এর নাম গোবর্ধন মঠ হয়। কিভাবে শিক্ষিত করে তোলা হত শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পূজারিদের ? পুজোর জন্য যাঁদের নির্বাচিত করা হত তাঁদের শঙ্করাচার্য়ের মঠে কিছুদিন থাকতে হত। বেদ-বেদান্তসহ হিন্দুধর্মের নানা শাস্ত্র সম্বন্ধে একটা সম্যক শিক্ষা শেষ হওয়ার পর মঠের প্রশংসাপত্র দেওয়া হত। এরপরই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার পুজো করার অধিকার পেতেন ওই পূজারিরা। অবশ্য পরবর্তী সময়ে গোবর্ধন মঠ অনিচ্ছা প্রকাশ করায় এই দায়িত্ব মুক্তিমণ্ডপের উপরই এসে পড়ে।
প্রত্যেকটি শাসনের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই গ্রামগুলির প্রতিটিতেই শিব, বিষ্ণু ও দুর্গার মন্দির আছে। বলভদ্র শিবের প্রতীক, জগন্নাথদেব বিষ্ণুর প্রতীক ও শক্তির প্রতীক হলেন সুভদ্রা। অতএব যে কোনও একটি শাসনের বাসিন্দারা ইচ্ছামতো তাঁদের ইষ্টদেবতার পুজো করতে পারেন। ফলে শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকেই মুক্তিমণ্ডপের পণ্ডিতদের নির্বাচন করা হয়। এবং শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পুজো অর্চনার ক্ষেত্রে এই তিন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানই অনুসরণ করা হয়।